ঢাকা ১০:৫০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শুঁটকির অর্থনৈতিক গুরুত্ব

নিজস্ব সংবাদ :

ড. এমএম মাহবুব আলম

প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি মাছের ভক্ত। তাই, আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি নামেই পরিচিত। তবে তাজা মাছের পাশাপাশি শুঁটকি ধনী-গরিব সবার খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। কোনো মাছকে সূর্যের তাপে বা শুষ্ক পরিবেশে বাতাসে শুকিয়ে এর ভেতরের জলীয় অংশ অপসারণ করে পরবর্তীতে খাবার উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করার পদ্ধতিকে মাছের শুঁটকিকরণ বলা হয় এবং মাছটি শুঁটকি মাছ নামে পরিচিতি পায়।

বাংলাদেশে শুঁটকি একটি জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবার। শুঁটকি মাছের নাম শুনলে অনেকেরই জিভে জল আসে, কেউ কেউ আবার এর গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তবে বৈচিত্র্যময় বাঙালির লোভনীয় এক খাদ্য উপাদানের নাম শুঁটকি তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মাছ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার না থাকায় অনেক সময় তাজা মাছ বাজারজাত করা সম্ভব হয় না।

তাই, মাছকে শুঁটকিতে রূপান্তরিত করা হয়। কম আর্দ্রতা স্থায়িত্বকাল প্রসারিত করে বিধায় শুঁটকি মাছের আয়ুষ্কাল তাজা মাছের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। শুঁটকি মাছ প্রায় ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত খাবারের উপযোগী থাকে। বড় বা ছোট যে কোনো ধরনের মাছের শুঁটকি করা সম্ভব। তবে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাছের শুঁটকি না করাই উত্তম। শুঁটকি তৈরির সব কার্যক্রমে অসংখ্য শ্রমিক ও ব্যবসায়ী জড়িত। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। এটি মাছ সংরক্ষণের একটি প্রাচীন প্রথা, যা প্রাথমিকভাবে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, খুলনা, ভোলা, সাতক্ষীরা, অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলসহ সিলেট এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে পরিচালিত হয়। জনপ্রিয় শুঁটকি মাছের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে লইট্টা, চিংড়ি, রিবনফিশ, ঈল এবং ছোট স্থানীয় মাছ। শুঁটকি মাছ শিল্প অভ্যন্তরীণ ব্যবহার এবং রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। শুঁটকি মাছ অনেক বাংলাদেশির একটি প্রধান খাবার হওয়ায় এর রয়েছে উচ্চ অভ্যন্তরীণ চাহিদা, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। বাংলাদেশি প্রবাসী জনসংখ্যার দেশগুলোয় শুঁটকি মাছ রপ্তানি করা হয়, যেমন যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বাংলাদেশ বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ উৎপাদন করে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ দুই হাজার ২২৪ দশমিক ৬২ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ রপ্তানি করে ৪৮ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা আয় করে। গুণগত মান বজায় রেখে শুঁটকি উৎপাদন করা গেলে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।

শুঁটকি মাছের পুষ্টিগুণ : শুঁটকিতে মাছের পুষ্টিমান অক্ষুণ্ণ থাকে। সাধারণভাবে, শুঁটকি মাছে উচ্চ প্রোটিন উপাদান এবং কম আর্দ্রতা থাকে, যা এটিকে পুষ্টির একটি ঘনীভূত উৎস করে তোলে। মাছের প্রজাতি, শুকানোর পদ্ধতি এবং পরিবেশগত অবস্থার ওপর ভিত্তি করে শুঁটকিতে শতকরা ৫০-৮০ ভাগ আমিষ, এক থেকে ১৫ ভাগ স্নেহ পদার্থ এবং চার থেকে ২০ ভাগ খনিজ লবণ থাকে। পানি শুকিয়ে যায় বলে প্রতি একক ওজনে তাজা মাছের চেয়ে শুঁটকিতে পুষ্টিমান চার থেকে ছয় গুণ বেশি। উচ্চ প্রোটিন এবং খনিজ এটিকে একটি অপরিহার্য খাদ্য উৎস করে তোলে।

মাছকে কেন শুঁটকি করা হয় : মাছের পচন রোধ করার লক্ষ্যে প্রধানত শুঁটকি করা হয়। মাছ পচনের অন্যতম তিনটি কারণ হলো- মাছের চর্বির জারণজনিত মাছের পচন, এনজাইমের প্রভাবে মাছের পচন এবং অণুজীবজনিত মাছের পচন। বিভিন্ন কারণে মাছের পচনের গতি বৃদ্ধি পায়, যেমন মাছ ধরার সময় মাছের ছোটাছুটি/উত্তেজনা, অসতর্কভাবে মাছ ধরে মাংসপেশি আহত/ক্ষতি করা, সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব, জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ ঘটানো, বরফ দিতে দেরি করা, কোনো পর্যায়ে সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসা, ইত্যাদি।

সূর্যালোকে মাছ শুঁটকিকরণ ও এর সীমাবদ্ধতা : বেশিরভাগ শুঁটকিকরণ এখনো খোলা জায়গায় ম্যানুয়ালি করা হয় যা মাছকে দূষিত করে। তবে কিছু আধুনিক শুকানোর কৌশল যেমন সোলার ড্রায়ার, হাইজেনিক র‍্যাক এবং যান্ত্রিক শুঁটকিকরণ শুঁটকির মান এবং স্বাস্থ্যবিধি উন্নত করার জন্য চালু করা হচ্ছে। শুঁটকিকরণ প্রক্রিয়ায় বাতাসের ক্রিয়া ও সূর্যালোকের প্রভাবে মাছের শরীরে জলীয় অংশ তথা আর্দ্রতা প্রায় ১৬ শতাংশের নিচে নেমে আসে। আংশিক লবণের ব্যবহার শুঁটকির গুণগত মান উন্নয়নে ও দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। ফলে ক্ষুদ্র অণুজীব (যেমন ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, ছত্রাক ইত্যাদি), পোকামাকড়ের লার্ভা প্রভৃতি শুঁটকি মাছের ভেতরে জন্ম নিতে বা বৃদ্ধি পেতে পারে না।

তবে সূর্যালোকে শুকিয়ে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেমন- শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের সাথে জড়িতদের মাছ প্রক্রিয়াকরণ, স্যানিটেশন এবং জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, সনাতন পদ্ধতিতে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুঁটকি তৈরির জন্য পচা মাছ ব্যবহার করা, ব্যবহৃত মাছ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়মে না ধরা এবং বরফ না দেয়া, স্বল্প পরিমাণ মাছের ক্ষেত্রে সাগর বা নদী তীরের বালিতে বা মাদুর বিছিয়ে শুকানো হয়, ফলে শুঁটকি ধুলা, বালি, কাদা এবং জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়, চর্বির পরিমাণ যা-ই থাকুক না কেন, দীর্ঘ সময় বাতাসে উন্মুক্ত থাকায় অক্সিজেনজনিত দুর্গন্ধতা তৈরি হওয়া, শুঁটকি তৈরি এবং সংরক্ষণের সময় নির্বিচারে অনিরাপদ কীটনাশক ব্যবহার করা যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, প্রক্রিয়াকৃত শুঁটকি সঠিকভাবে প্যাকেটজাত না করা ইত্যাদি।

শুঁটকিতে পোকাণ্ডমাকড়ের আক্রমণ : মাছ শুকানোর শুরুর দিকে ব্লফ্লাই লার্ভি (মাগোটস/লক) আক্রমণ করে। যদি মাছকে দ্রুত শুকানো হয় তাহলে লার্ভি মারা যায় অথবা স্থান ত্যাগ করে। এরা মাছের উপরে বা ভেতরে ডিম পাড়ে। তাই, যদি সকালে মাছকে রোদে দেয়া হয় এবং সারা দিন রোদে শুকাই তাহলে এদের ডিম মরে যায়। লবণ প্রয়োগ করলে এ পোকার আক্রমণ কম হয়। শুঁটকি গুদামজাত/সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণের সময় বিটল (কাইশ্যা পোকা) এবং মাইট (গুন পোকা) পোকা আক্রমণ করে। প্রাপ্তবয়স্ক এবং লার্ভি উভয়ই আক্রমণ করে। শুঁটকি ছয় মাস গুদামে রাখলে এদের দ্বারা প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষতি হয়।

সনাতন পদ্ধতির প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার উপায় : শুঁটকি তৈরিতে ব্যবহৃত মাছের গুণগত মান, মাছ ধরা, স্যানিটেশন, শুকানোর প্রক্রিয়া, গুদামজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ওপর শুঁটকি প্রস্তুতকারকদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। উত্তম মানের মাছ থেকে শুঁটকি করতে হবে। ঢাকনাযুক্ত উঁচু মাচা/তাক/বক্স/রিং টানেল/অন্য কোনো যন্ত্র মাছ শুকানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে।

শুঁটকি সঠিকভাবে প্যাকেট করে ঢাকনাযুক্ত কন্টেইনারে রাখতে হবে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পোকামাকড় প্রতিহত করতে সঠিক পরিমাণে সোলার লবণ ব্যবহার করতে হবে। পোকামাকড় প্রতিহত করতে কোনো ধরনের পোকা কখন, কীভাবে আক্রমণ করে তা জানতে হবে।

নিরাপদ এবং আরো স্বাস্থ্যকর শুকনো মাছের পণ্য নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং সংস্থা মাছ শুকানোর কৌশল উন্নত করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), ময়মনসিংহের প্রফেসর ড. একেএম নওশাদ আলম মাছ প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে উন্নত মাছ শুকানোর কৌশল উদ্ভাবনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি উন্নত শুষ্ক র‌্যাক ব্যবহার করে মাছ শুকানোর বিষয়ে একটি প্রদর্শনী প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল লিখেছেন যা নিরাপদ এবং উচ্চ মানের শুকনো মাছের পণ্য উৎপাদনের জন্য ঐতিহ্যবাহী মাছ শুকানোর পদ্ধতি বাড়ানোর নির্দেশিকা প্রদান করে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষকরা শুঁটকি মাছের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি তৈরি করেছেন, যার লক্ষ্য স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ শুকনো মাছের পণ্য উৎপাদন করা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসরগণ যান্ত্রিক ফিশ ড্রায়ার ব্যবহার করে শুঁটকি মাছের পণ্য উন্নত করার ওপর গবেষণা চালিয়েছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের গবেষকরা শুঁটকি মাছের পুষ্টি ও জীবাণু গুণমান উন্নত করার জন্য কম খরচে উন্নত পদ্ধতির সন্ধান করেছেন, যেমন সোলার চিমনি ড্রায়ার।

বর্তমানে উন্নত ড্রাইং র‌্যাক, বহুতল বিশিষ্ট শুকানোর মাচা/তাক, গ্রাউন্ড বক্স টানেল, ঝুলন্ত রিং টানেল, ঝুলন্ত বক্স টানেল, ঝুলন্ত বক্স টানেল তৈরির কৌশল, ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছের শুঁটকিকরণ করা হচ্ছে বিধায় শুঁটকির গুণগত মান উন্নত হচ্ছে।

শুঁটকির গুণগত মান রক্ষা করতে করণীয়-

কেইজ হার্ডেনিং : শুঁটকি দেখতে চকের ন্যায় সাদা, ভঙ্গুর এবং শক্ত হয়। এ ধরনের শুঁটকির বেশি দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না কারণ এরা ভেতরে ভেজা থাকে। এ সমস্যার সমাধান করতে শুঁটকিকে ভালো করে শুকাতে হবে।

ভঙ্গুর শুঁটকি : শুঁটকি তৈরির কোনো পর্যায়ে মাছ সিদ্ধ হয়ে যায়। সোলার ড্রায়ারে যখন তাপমাত্রা ৫৫-৬০ সে. ডিগ্রির ওপর হয়ে যায় তখন এটা হয়। এ ধরনের শুঁটকি বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সোলার ড্রায়ারে তাপমাত্রা ৫০ সে. ডিগ্রির নিচে রাখতে হবে।

ছত্রাক জন্মানো : উৎপাদিত শুঁটকিতে যখন পানির পরিমাণ বেশি থাকে তখন কাল, নীল এবং সবুজ রংয়ের ছত্রাক জন্মায়। এ সমস্যার সমাধান করতে শুঁটকিতে পানির পরিমাণ ২০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে এবং ভালোভাবে প্যাকেট করতে হবে।

শুঁটকি লাল হয়ে যাওয়া : পচা মাছ দিয়ে শুঁটকি তৈরি করলে এমন হয়। খারাপ মানের লবণ ব্যবহার করলে লবণপ্রেমী ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়েও শুঁটকি লাল হতে পারে। এটি প্রতিরোধ করতে হলে সতেজ মাছ থেকে শুঁটকি করতে হবে এবং ভালো মানের লবণ ব্যবহার করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, মৎস্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য
আপডেট সময় ০১:০৯:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
১৯ বার পড়া হয়েছে

শুঁটকির অর্থনৈতিক গুরুত্ব

আপডেট সময় ০১:০৯:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ড. এমএম মাহবুব আলম

প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি মাছের ভক্ত। তাই, আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি নামেই পরিচিত। তবে তাজা মাছের পাশাপাশি শুঁটকি ধনী-গরিব সবার খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। কোনো মাছকে সূর্যের তাপে বা শুষ্ক পরিবেশে বাতাসে শুকিয়ে এর ভেতরের জলীয় অংশ অপসারণ করে পরবর্তীতে খাবার উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করার পদ্ধতিকে মাছের শুঁটকিকরণ বলা হয় এবং মাছটি শুঁটকি মাছ নামে পরিচিতি পায়।

বাংলাদেশে শুঁটকি একটি জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবার। শুঁটকি মাছের নাম শুনলে অনেকেরই জিভে জল আসে, কেউ কেউ আবার এর গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তবে বৈচিত্র্যময় বাঙালির লোভনীয় এক খাদ্য উপাদানের নাম শুঁটকি তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মাছ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার না থাকায় অনেক সময় তাজা মাছ বাজারজাত করা সম্ভব হয় না।

তাই, মাছকে শুঁটকিতে রূপান্তরিত করা হয়। কম আর্দ্রতা স্থায়িত্বকাল প্রসারিত করে বিধায় শুঁটকি মাছের আয়ুষ্কাল তাজা মাছের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। শুঁটকি মাছ প্রায় ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত খাবারের উপযোগী থাকে। বড় বা ছোট যে কোনো ধরনের মাছের শুঁটকি করা সম্ভব। তবে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাছের শুঁটকি না করাই উত্তম। শুঁটকি তৈরির সব কার্যক্রমে অসংখ্য শ্রমিক ও ব্যবসায়ী জড়িত। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। এটি মাছ সংরক্ষণের একটি প্রাচীন প্রথা, যা প্রাথমিকভাবে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, খুলনা, ভোলা, সাতক্ষীরা, অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলসহ সিলেট এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে পরিচালিত হয়। জনপ্রিয় শুঁটকি মাছের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে লইট্টা, চিংড়ি, রিবনফিশ, ঈল এবং ছোট স্থানীয় মাছ। শুঁটকি মাছ শিল্প অভ্যন্তরীণ ব্যবহার এবং রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। শুঁটকি মাছ অনেক বাংলাদেশির একটি প্রধান খাবার হওয়ায় এর রয়েছে উচ্চ অভ্যন্তরীণ চাহিদা, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। বাংলাদেশি প্রবাসী জনসংখ্যার দেশগুলোয় শুঁটকি মাছ রপ্তানি করা হয়, যেমন যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বাংলাদেশ বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ উৎপাদন করে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ দুই হাজার ২২৪ দশমিক ৬২ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ রপ্তানি করে ৪৮ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা আয় করে। গুণগত মান বজায় রেখে শুঁটকি উৎপাদন করা গেলে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।

শুঁটকি মাছের পুষ্টিগুণ : শুঁটকিতে মাছের পুষ্টিমান অক্ষুণ্ণ থাকে। সাধারণভাবে, শুঁটকি মাছে উচ্চ প্রোটিন উপাদান এবং কম আর্দ্রতা থাকে, যা এটিকে পুষ্টির একটি ঘনীভূত উৎস করে তোলে। মাছের প্রজাতি, শুকানোর পদ্ধতি এবং পরিবেশগত অবস্থার ওপর ভিত্তি করে শুঁটকিতে শতকরা ৫০-৮০ ভাগ আমিষ, এক থেকে ১৫ ভাগ স্নেহ পদার্থ এবং চার থেকে ২০ ভাগ খনিজ লবণ থাকে। পানি শুকিয়ে যায় বলে প্রতি একক ওজনে তাজা মাছের চেয়ে শুঁটকিতে পুষ্টিমান চার থেকে ছয় গুণ বেশি। উচ্চ প্রোটিন এবং খনিজ এটিকে একটি অপরিহার্য খাদ্য উৎস করে তোলে।

মাছকে কেন শুঁটকি করা হয় : মাছের পচন রোধ করার লক্ষ্যে প্রধানত শুঁটকি করা হয়। মাছ পচনের অন্যতম তিনটি কারণ হলো- মাছের চর্বির জারণজনিত মাছের পচন, এনজাইমের প্রভাবে মাছের পচন এবং অণুজীবজনিত মাছের পচন। বিভিন্ন কারণে মাছের পচনের গতি বৃদ্ধি পায়, যেমন মাছ ধরার সময় মাছের ছোটাছুটি/উত্তেজনা, অসতর্কভাবে মাছ ধরে মাংসপেশি আহত/ক্ষতি করা, সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব, জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ ঘটানো, বরফ দিতে দেরি করা, কোনো পর্যায়ে সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসা, ইত্যাদি।

সূর্যালোকে মাছ শুঁটকিকরণ ও এর সীমাবদ্ধতা : বেশিরভাগ শুঁটকিকরণ এখনো খোলা জায়গায় ম্যানুয়ালি করা হয় যা মাছকে দূষিত করে। তবে কিছু আধুনিক শুকানোর কৌশল যেমন সোলার ড্রায়ার, হাইজেনিক র‍্যাক এবং যান্ত্রিক শুঁটকিকরণ শুঁটকির মান এবং স্বাস্থ্যবিধি উন্নত করার জন্য চালু করা হচ্ছে। শুঁটকিকরণ প্রক্রিয়ায় বাতাসের ক্রিয়া ও সূর্যালোকের প্রভাবে মাছের শরীরে জলীয় অংশ তথা আর্দ্রতা প্রায় ১৬ শতাংশের নিচে নেমে আসে। আংশিক লবণের ব্যবহার শুঁটকির গুণগত মান উন্নয়নে ও দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। ফলে ক্ষুদ্র অণুজীব (যেমন ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, ছত্রাক ইত্যাদি), পোকামাকড়ের লার্ভা প্রভৃতি শুঁটকি মাছের ভেতরে জন্ম নিতে বা বৃদ্ধি পেতে পারে না।

তবে সূর্যালোকে শুকিয়ে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেমন- শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের সাথে জড়িতদের মাছ প্রক্রিয়াকরণ, স্যানিটেশন এবং জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, সনাতন পদ্ধতিতে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুঁটকি তৈরির জন্য পচা মাছ ব্যবহার করা, ব্যবহৃত মাছ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়মে না ধরা এবং বরফ না দেয়া, স্বল্প পরিমাণ মাছের ক্ষেত্রে সাগর বা নদী তীরের বালিতে বা মাদুর বিছিয়ে শুকানো হয়, ফলে শুঁটকি ধুলা, বালি, কাদা এবং জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়, চর্বির পরিমাণ যা-ই থাকুক না কেন, দীর্ঘ সময় বাতাসে উন্মুক্ত থাকায় অক্সিজেনজনিত দুর্গন্ধতা তৈরি হওয়া, শুঁটকি তৈরি এবং সংরক্ষণের সময় নির্বিচারে অনিরাপদ কীটনাশক ব্যবহার করা যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, প্রক্রিয়াকৃত শুঁটকি সঠিকভাবে প্যাকেটজাত না করা ইত্যাদি।

শুঁটকিতে পোকাণ্ডমাকড়ের আক্রমণ : মাছ শুকানোর শুরুর দিকে ব্লফ্লাই লার্ভি (মাগোটস/লক) আক্রমণ করে। যদি মাছকে দ্রুত শুকানো হয় তাহলে লার্ভি মারা যায় অথবা স্থান ত্যাগ করে। এরা মাছের উপরে বা ভেতরে ডিম পাড়ে। তাই, যদি সকালে মাছকে রোদে দেয়া হয় এবং সারা দিন রোদে শুকাই তাহলে এদের ডিম মরে যায়। লবণ প্রয়োগ করলে এ পোকার আক্রমণ কম হয়। শুঁটকি গুদামজাত/সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণের সময় বিটল (কাইশ্যা পোকা) এবং মাইট (গুন পোকা) পোকা আক্রমণ করে। প্রাপ্তবয়স্ক এবং লার্ভি উভয়ই আক্রমণ করে। শুঁটকি ছয় মাস গুদামে রাখলে এদের দ্বারা প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষতি হয়।

সনাতন পদ্ধতির প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার উপায় : শুঁটকি তৈরিতে ব্যবহৃত মাছের গুণগত মান, মাছ ধরা, স্যানিটেশন, শুকানোর প্রক্রিয়া, গুদামজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ওপর শুঁটকি প্রস্তুতকারকদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। উত্তম মানের মাছ থেকে শুঁটকি করতে হবে। ঢাকনাযুক্ত উঁচু মাচা/তাক/বক্স/রিং টানেল/অন্য কোনো যন্ত্র মাছ শুকানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে।

শুঁটকি সঠিকভাবে প্যাকেট করে ঢাকনাযুক্ত কন্টেইনারে রাখতে হবে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পোকামাকড় প্রতিহত করতে সঠিক পরিমাণে সোলার লবণ ব্যবহার করতে হবে। পোকামাকড় প্রতিহত করতে কোনো ধরনের পোকা কখন, কীভাবে আক্রমণ করে তা জানতে হবে।

নিরাপদ এবং আরো স্বাস্থ্যকর শুকনো মাছের পণ্য নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং সংস্থা মাছ শুকানোর কৌশল উন্নত করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), ময়মনসিংহের প্রফেসর ড. একেএম নওশাদ আলম মাছ প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে উন্নত মাছ শুকানোর কৌশল উদ্ভাবনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি উন্নত শুষ্ক র‌্যাক ব্যবহার করে মাছ শুকানোর বিষয়ে একটি প্রদর্শনী প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল লিখেছেন যা নিরাপদ এবং উচ্চ মানের শুকনো মাছের পণ্য উৎপাদনের জন্য ঐতিহ্যবাহী মাছ শুকানোর পদ্ধতি বাড়ানোর নির্দেশিকা প্রদান করে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষকরা শুঁটকি মাছের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি তৈরি করেছেন, যার লক্ষ্য স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ শুকনো মাছের পণ্য উৎপাদন করা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসরগণ যান্ত্রিক ফিশ ড্রায়ার ব্যবহার করে শুঁটকি মাছের পণ্য উন্নত করার ওপর গবেষণা চালিয়েছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের গবেষকরা শুঁটকি মাছের পুষ্টি ও জীবাণু গুণমান উন্নত করার জন্য কম খরচে উন্নত পদ্ধতির সন্ধান করেছেন, যেমন সোলার চিমনি ড্রায়ার।

বর্তমানে উন্নত ড্রাইং র‌্যাক, বহুতল বিশিষ্ট শুকানোর মাচা/তাক, গ্রাউন্ড বক্স টানেল, ঝুলন্ত রিং টানেল, ঝুলন্ত বক্স টানেল, ঝুলন্ত বক্স টানেল তৈরির কৌশল, ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছের শুঁটকিকরণ করা হচ্ছে বিধায় শুঁটকির গুণগত মান উন্নত হচ্ছে।

শুঁটকির গুণগত মান রক্ষা করতে করণীয়-

কেইজ হার্ডেনিং : শুঁটকি দেখতে চকের ন্যায় সাদা, ভঙ্গুর এবং শক্ত হয়। এ ধরনের শুঁটকির বেশি দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না কারণ এরা ভেতরে ভেজা থাকে। এ সমস্যার সমাধান করতে শুঁটকিকে ভালো করে শুকাতে হবে।

ভঙ্গুর শুঁটকি : শুঁটকি তৈরির কোনো পর্যায়ে মাছ সিদ্ধ হয়ে যায়। সোলার ড্রায়ারে যখন তাপমাত্রা ৫৫-৬০ সে. ডিগ্রির ওপর হয়ে যায় তখন এটা হয়। এ ধরনের শুঁটকি বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সোলার ড্রায়ারে তাপমাত্রা ৫০ সে. ডিগ্রির নিচে রাখতে হবে।

ছত্রাক জন্মানো : উৎপাদিত শুঁটকিতে যখন পানির পরিমাণ বেশি থাকে তখন কাল, নীল এবং সবুজ রংয়ের ছত্রাক জন্মায়। এ সমস্যার সমাধান করতে শুঁটকিতে পানির পরিমাণ ২০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে এবং ভালোভাবে প্যাকেট করতে হবে।

শুঁটকি লাল হয়ে যাওয়া : পচা মাছ দিয়ে শুঁটকি তৈরি করলে এমন হয়। খারাপ মানের লবণ ব্যবহার করলে লবণপ্রেমী ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়েও শুঁটকি লাল হতে পারে। এটি প্রতিরোধ করতে হলে সতেজ মাছ থেকে শুঁটকি করতে হবে এবং ভালো মানের লবণ ব্যবহার করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, মৎস্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।